বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান-২১০০ সঠিক বাস্তবায়ন : মৎস্য সেক্টরে উজ্জ্বল সম্ভাবনা
মো. সাইফুল ইসলাম১ পারভেজ চৌধুরী২ মো: হাসিবুর রহমান৩
ডেল্টা প্লান ২১০০ হচ্ছে বাংলাদেশের শতবর্ষ মেয়াদি একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা। সামনের দিনে দীর্ঘমেয়াদি প্রযুক্তিগত, কারিগরি ও আর্থসামাজিক দলিল হিসেবে এ পরিকল্পনা বিবেচিত হবে। পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে যা কৃষি তথা মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ। একই ধরনের দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা জেলাগুলোকে অভিন্ন গ্রুপ বা হটস্পটে চিহ্নিত করে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ২ লাখ ৯৭ হাজার ৮২৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনায় হটস্পটগুলোর চ্যালেঞ্জ ও সমস্যা সমাধানে বেশকিছু কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে। বদ্বীপ পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হবে পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও পরিবর্তিত জলবায়ু মোকাবিলার মাধ্যমে যা দেশে ক্রমবর্ধমান মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাছাড়া এ পরিকল্পনার হটস্পট খড়াপ্রবণ এলাকায় পানির সুব্যবস্থা, উপকূলীয় অঞ্চলে জলবাযুর প্রভাব হ্রাস ও হাওড় অঞ্চল সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৎস্য খাতের উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখবে বলে আশা করা যায়।
ডেল্টা হটস্পট বাস্তবায়ন এবং মৎস্য সেক্টরে ভূমিকা
বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০-তে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বিষয়ের অন্যতম হলো আন্তঃদেশীয় নদী ব্যবস্থাপনা, উপকূলীয় অঞ্চল, হাওড় ও প্লাবনভূমি রক্ষা। এ ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারলে দেশীয় মাছসহ অন্যান্য মাছের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাচুর্যতা বৃদ্ধি পাবে। ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের মাধ্যমে দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকা চিহ্নিত হটস্পট উপকূলীয় অঞ্চল ১৯টি জেলার ২৭,৭৩৮ বর্গকিলোমিটার, বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল ১৮টি জেলার ২২,৮৪৮ বর্গকিলোমিটার, হাওড় এবং আকস্মিক বন্যা প্রবণ ৭টি জেলার ১৬,৫৭৪ বর্গকিলোমিটার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ৩টি জেলার ১৩,২৯৫ বর্গকিলোমিটার, নদী অঞ্চল ও মোহনা ২৯টি জেলার ৩৫,২০৪ বর্গকিলোমিটার এবং নগর এলাকাসমূহ ৭টি জেলার ১৯,৮২৩ বর্গকিলোমিটার প্রভৃতি এলাকাসমূহ যথাযথ ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে।
উপকূলীয় অঞ্চল
বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ি চাষের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। এদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে বর্তমানে হেক্টরপ্রতি চিংড়ির উৎপাদনের হার পাশ্ববর্তী চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশগুলোর তুলনায় অনেক কম। তবে উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষের ম্যধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। একইসাথে উপকূলীয় অঞ্চলে শিল্পবর্জ্য, নৌযান থেকে চুইয়ে পড়া তেল, সুন্দরবনে বেআইনি মাছ আহরণ, উজান থেকে বেশি পরিমাণে পলি জমা, বঙ্গোপসাগরে মাছের মজুদ সম্পর্কে অজ্ঞতা, দূষণ ইত্যাদি প্রধান সমস্যারূপে দেখা দিয়েছে।
বরেন্দ্র ও খরাপ্রবণ অঞ্চল
জলাবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব বিবেচনায় পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন দেশের বরেন্দ্র ও উত্তরাঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচনে মৎস্য চাষের উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরাঞ্চলে ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিল, প্লাবনভূমি ও মরা নদীতে মাছ চাষে উদ্যোগ গ্রহণ করলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দরিদ্র/প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
হাওড় এবং আকস্মিক বন্যাপ্রবণ এলাকাসমূহ
বাংলাদেশের বিস্তৃত হাওড় ও প্লাবনভূমি অঞ্চলে মাছের উৎপাদন ঋতুভিত্তিক এবং তা অনেক সময় ঝুঁকির মুখে পড়ে। তাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, বন্যা ও অনাবৃষ্টির কারণে জীববৈচিত্র্য ও উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্লাবনভিত্তিক মৌসুমি কাদাযুক্ত এলাকা, গভীর-অগভীর জলাশয়, প্লাবনভূমি ও হাওড়ে প্রাকৃতিক জলাভূমি সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে তা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
নদী অঞ্চল এবং মোহনা
বাংলাদেশ মূলত নদী বিধৌত দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনসহ মানবসৃষ্ট কারণে দেশের নদ-নদী হতে মাছের উৎপাদন ক্রমহ্রাসের সাথে সাথে জীববৈচিত্র্যও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রতি বছর বর্ষাকালে প্রায় সব নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করে, আবার শীতকালে পানি কমে যাওয়ায় নদী শুকিয়ে পলি জমে নদীর মুখ ও মোহনা ভরাট হয়। শুষ্ক মৌসুমের শুরুতেই নদীর পানির স্রোত আশঙ্কাজনকভাবে কমে যায় ফলে নদী ও মোহনা ভরাট হওয়ায় মৎস্য উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তাই নদী ব্যবস্থাপনার কৌশল প্রয়োগে এ হতে মৎস্যসম্পদের উৎপাদনবৃদ্ধি করা যাবে বলে আশা করা যায়।
ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নে মৎস্যসম্পদ উন্নয়ন কর্মকৌশল
নদীমাতৃক বাংলাদেশে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান, কর্মসংস্থান এবং সর্বোপরি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে মৎস্যচাষ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে বিবেচিত। বর্তমানে মিঠাপানিতে চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ২য়। পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ ও নদী বিধৌত এদেশে কৃষি ও অর্থনীতিতে নদী, বিলÑহাওড় ও উপকূলীয় জলাভূমির প্রভাব অপরিসীম। কিন্তু প্রতি বছর বাংলাদেশে দুর্বল পানি ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোর কারণে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবর্তিত জলবায়ু প্রভাব ও হটস্পটগুলো সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা গেলে কৃষি ও মৎস্য সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি ও টেকসই উন্নয়ন করা সম্ভবপর হবে। ডেল্টা প্লান-২১০০ বাস্তবায়নে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির নিমিত্তে ৯টি কৌশলগত উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
এগুলো হলো-প্রাকৃতিক সম্পদ পুনরুদ্ধার; জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ; নতুন সমুদ্র সীমানায় মৎস্যসম্পদ আহরণ; মানবসম্পদ উন্নয়ন; বর্ধিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি; জেলে সম্প্রদায়ের ক্ষমতায়ন; মৎস্য ব্যবস্থাপনায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও উন্নয়ন; বৃহৎ মৎস্য গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন; মৎস্য ব্যবস্থাপনায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলোর সমন্বয় বৃদ্ধি।
ডেল্টা প্লান বাস্তবায়ন ও মৎস্য সেক্টরে সম্ভাবনা
ডেল্টা প্লান সরকারের রূপকল্প ২০৪১, এসডিজি ২০৩০ এবং পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকে প্রতিনিধিত্ব করে বিধায় জলবায়ু পরিবর্তন, সুনীল অর্থনীতি এবং টেকসই অভীষ্ট লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। এই পরিকল্পনা প্রণয়নে দেশের ৮টি হাইড্রোলজিক্যাল অঞ্চলকে ভিত্তি হিসেবে ধরে প্রতিটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির মাত্রা চিহ্নিত করা হয়েছে যা কৃষি তথা মৎস্যসম্পদ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ। সর্বোপরি বদ্বীপ-২১০০ উল্লিখিত মৎস্য কর্মকৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হলে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো অর্জিত হতে পারে। যেমন : ১. বর্তমানে ব্লু ইকোনমি এবং সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ এর অপার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামুদ্রিক মৎস্য ও মৎস্যপণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানির অন্যতম খাত হতে পারে। ২. আন্তঃদেশীয় নদী ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে গ্রহণ করতে পারলে দেশীয় মাছসহ অন্যান্য মাছের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও প্রাচুর্যতা বৃদ্ধি পাবে। ৩. উপকূলীয় অঞ্চলে চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধি ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষের মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। একইসাথে উপকূলীয় অঞ্চলে শিল্পবর্জ্য, নৌযান থেকে চুইয়ে পড়া তেল, সুন্দরবনে বেআইনি মাছ আহরণ, উজান থেকে বেশি পরিমাণে পলি জমা, বঙ্গোপসাগরে মাছের মজুদ সম্পর্কে অজ্ঞতা, দূষণ রোধ সম্ভব হবে। ৪. বিল, প্লাবনভূমি ও মরা নদীতে মাছ চাষে উদ্যোগ গ্রহণ করলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি দরিদ্র/প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মাছ চাষের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ৫. হাওড়সহ মৌসুমি কাদাযুক্ত এলাকা, গভীর-অগভীর জলাশয় ও প্লাবনভূমিতে প্রাকৃতিক জলাভূমি সংরক্ষণের লক্ষ্যে স্থায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে তা মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি ও নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে।
পানি ব্যবস্থাপনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় তৈরি হওয়া ‘ডেল্টা প্লান ২১০০’ দেশের মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০’র সফল বাস্তবায়নে কার্যকরী কৌশল অবলম্বন এবং পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনায় ন্যায়সঙ্গত সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে দেশের জলাভূমির সর্বোচ্চ ও যথোপযুক্ত ব্যবহার ও পরিবেশগত স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যা মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। পরিশেষে বলা যায় ‘ডেল্টা প্লান ২১০০’ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন হলে পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে টেকসই মৎস্যসম্পদ উৎপাদনে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। য়
১,২,৩বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ। মোবাইল : ০১৭৪৪১৪৫৪৭৮, ই-মেইল : kasibkhan94bfri@gmail.com